মুঘল সম্রাট আবুল ফাতাহ জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবরের রাজত্ব ও দ্বীনে ইলাহী

হিমালয়ান উপমহাদেশে মধ্যযুগের ইতিহাসে মােঘল শাসনামল অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ উপমহাদেশে মােঘল সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থান বলতে গেলে এক নবযুগের সূচনা করে। প্রাক মােঘল যুগে মুসলিম নৃপতিগণ সুলতানরূপে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মােঘলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের সম্রাট বলে ঘােষণা করেন। মােঘল সম্রাটদের মাঝে বাদশাহ আকবরই সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ শাসক, সাহসী বীর, অনন্য সাধারণ সামরিক প্রতিভা সম্পন্ন সেনাপতি ও সামরিক সংস্কারক এবং বাহ্যিক দিক বিবেচনায় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। তার রাজত্বকাল ছিল পঞ্চাশ বছর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রীঃ)। তবে দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন করে তিনি ইসলামের ইতিহাসে এক কালাে অধ্যায়ের সূচনা করেন এবং মুসলিম উম্মাহর কাছে চির ধিকৃত হয়ে আছেন। 


মােঘল সম্রাট আবুল ফাতাহ জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবরের রাজত্ব ও দ্বীনে ইলাহী। Divine in the reign and religion of Mughal Emperor Akbar


জন্ম ও পরিচয়: 

ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ শতাব্দীতে আকবরের পিতা হুমায়ূন শের শাহের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভারতবর্ষ হতে স্ত্রী হামিদা বানুসহ সিন্ধুর অমরকোর্টের হিন্দু রাজা রানা প্রসাদের রাজ্যে পলায়ন করেন। সেখানে নির্বাসিত জীবন যাপন কালে ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে নভেম্বর আবুল ফাতাহ জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবর এর জন্ম হয়। কথিত আছে যে, আকবরের জন্মের সংবাদ পেয়ে হুমায়ূন একটি মৃগনাভী বিতরণ করে উপস্থিত আমীরদের নিকট আশা ব্যক্ত করেন যে, তার পুত্রের যশ ও সুখ্যাতি সুগন্ধি মৃগনাভীর মত যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক জীবন ও পিতা হুমায়ুনের মৃত্যুকালে আকবর তার অভিভাবক বৈরাম খানের সাথে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার একটি শহরে ছিলেন। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে মাত্র ১৩ বৎসর বয়সে (১৪ইং ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬) তিনি দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার পিতার অতি বিশ্বস্ত সহচর ও বন্ধু বৈরাম খান নাবালক সম্রাটের অভিভাবক নিযুক্ত হন। 

অভিভাবকত্বের প্রতি আকবরের অনীহাঃ 

 কিশাের আকবর সিংহাসনে আরােহণ করলেও মূলতঃ সে সময়ে তার বিচক্ষণ ও দূরদর্শী অভিভাবক বৈরাম খানই। সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। বৈরাম খান শিয়া সম্প্রদায়ের লােক ছিলেন। তিনি স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, পক্ষপাতিত্ব স্বেচ্ছাচারিতা, জনগণের সাথে রূঢ় আচরণ ইত্যাদির মাধ্যমে রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করেন। এ সমস্ত কারণে আকবর তার অভিভাবকত্বের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। মূলতঃ বৈরাম খানের সহযােগিতায়ই আকবর সিংহাসন লাভ করতে সক্ষম হন। কিন্তু উপরােল্লেখিত অসুবিধাগুলোর কারণে আকবর তাকে পদচ্যুত করেন। তবে ঐতিহাসিক বাদানী ও আরও অনেকের মতে মােঘল সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষায় বৈরামের অবদান অনস্বীকার্য। বাদানী বলেন: তার জ্ঞান, উদারতা, আন্তরিকতাবোধ, মধুর ব্যবহার, আনুগত্য এবং নম্র স্বভাবের জন্য তিনি সকলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ এ কারণে আমীর-উমারাগণ ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে আকবরকে উস্কে দেয় এবং স্বহস্তে ক্ষমতা ভার গ্রহণের জন্য তাকে অনুপ্রাণিত করে। 

আকবরের শাসন ব্যবস্থা:  

১. কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

 সম্রাট আকবর নিজে শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন। তার সময় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক প্রতিভাবান ব্যক্তিমাত্রই রাজকার্যে উচ্চপদে স্থান পেতেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ তাকে প্রজা মঙ্গলকারী স্বৈরাচারী শাসক' বলে অভিহিত করেন। কেন্দ্রের অধীনস্থ বিভিন্ন মন্ত্রীদের দায়িত্বে নানা বিভাগ ছিল। যেমনঃ (ক) অর্থনৈতিক বিভাগ (খ) সমর, বেতন ও হিসাব বিভাগ (গ) বিচার বিভাগ (ঘ) গণচরিত্র পর্যবেক্ষণ বিভাগ (ঙ) অস্ত্র বিভাগ (চ) গুপ্তচর বিভাগ (ছ) ডাক বিভাগ ইত্যাদি।

২. প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা:

 শাসন ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করার জন্য আকবর তার সুবিশাল সাম্রাজ্যকে ১৫টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। যিনি প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হতেন তাকে নাযিম বলা হত। আর বিচার বিভাগের জন্য প্রধান কাজী তিনি নিজে নিযুক্ত করতেন। আর অন্যান্য কাজীগণ প্রধান কাজী কর্তৃক নিযুক্ত।

রাজস্বনীতি:

 রাজস্ব বিভাগের সংস্কারে শের শাহের অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তীকালে শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে আকবর যে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জন করেন, তা তার অসামান্য প্রতিভা ও মেধারই পরিচায়ক। তার রাজস্ব ব্যবস্থায় ভূমিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: (১) পােলাহ (যা সব সময় আবাদ হত) (২) পরৌতি (যা বৎসরের কিছু সময় পতিত রাখা হত) (৩) তেহার (যা তিন চার বৎসর পতিত থাকত) (৪) বন্যর (যা বৎসরের অধিক সময় পতিত থাকত)। 

রাজপুতনীতি:

 আকবর তার সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্ব ও উন্নতি বিধানের লক্ষ্যে যে সব নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন; তার মাঝে রাজপুতনীতি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রতাপশালী রাজপুতদের সমর্থন লাভের জন্য তিনি তাদের সাথে মিলনাত্মক নীতি গ্রহণ করেন এবং রাজপূতদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তাছাড়া সামরিক ও বেসামরিক উভয় বিভাগের উচ্চ পদে তাদেরকে নিয়ােগ দান করেন।

একজন মুসলিম বাদশা হিসেবে কোন পথে তাকে চলতে হবে আর কোন পথ পরিহার করতে হবে এ যেন তিনি অন্ধের মতই বুঝতে সক্ষম হননি। আকবর ভাবলেন ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােক অমুসলিম। বিশেষত শৌর্য বীর্যের প্রতীক রাজপুত জনগােষ্ঠীর সাহায্য ও সহযােগিতা তার একান্ত প্রয়ােজন। কেননা তারা মােঘল রাজবংশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। তাই শক্তিশালী রাজন্যবর্গ ও জনগণের সাহায্য ও সহযােগিতা লাভ এবং তাদের মেধা শ্রম রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজে নিয়ােগ করার জন্য রাজপুতদের সাথে তিনি যে উদারনীতি এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাই রাজপুতনীতি বলে খ্যাত। 

বৈবাহিক সম্পর্ক:

 ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে আকবর অম্বরের রাজা বিহারি মলের কন্যা যােধাবাঈ এবং ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে বিকানীরের রাজা কল্যাণ মল এবং জয়সল মীরের রাজার কন্যাদ্বয়কেও বিবাহ করেন। তার পুত্র সেলিমকে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জয়পুরের ভগবান দাসের কন্যার সাথে বিবাহ দেয়া হয়। এভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আকবর শক্তিশালী রাজপুত বীরদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযােগিতা ও সম্প্রীতি লাভ করেন। 

মনসবদারী প্রথা প্রবর্তন: 

সম্রাট আকবর প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রেই আমূল সংস্কার সাধন করেন। বিশেষ করে তিনি সেনাবাহিনীকে 'অধিকতর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গড়ে তুলেন। তিনি সেবাহিনীতে মনসবদারী প্রথা প্রবর্তন করেন। তার সামরিক সংস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারী প্রথার প্রবর্তন এবং সেনাবাহিনীর পূণর্গঠন। একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি সামরিক কৃতিত্বের মাধ্যমে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজেতাদের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। 

সাম্রাজ্য বিস্তার ও বিদ্রোহ দমন: 

আকবর রাজ্য সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করে। বিভিন্ন রাজ্য জয় করেন যেমন: গন্ডােয়ানা, রাজপুতনা, গুজরাট, বাংলা ও সিন্ধু ইত্যাদি। তার আমলে যেসব বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে সেগুলিকে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। তার মাঝে উজবেক বিদ্রোহ, বাংলা বিদ্রোহ ও মির্জা হাকিমের বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। 

আকবরের প্রাথমিক ধর্মবিশ্বাস:

 প্রথমে আকবর একজন সাদাসিধা সরল বিশ্বাসী মুসলমান ছিলেন। তিনি আলিম সমাজ, পীর বুজুর্গগণকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। ইলম ও ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়াদি জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করতেন এবং এ জন্য তিনি সপ্তাহে সাত দিনের জন্য সাতজন ইমাম নিয়ােগ করে ছিলেন। হজ্জ্ব ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যাপারেও অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন। আকবরের ধর্মনীতির পরিবর্তন ও আকবরের ধর্মনীতির পরিবর্তনের ব্যাপারে যে বিষয়টি বেশি প্রভাব বিস্তার করে তা হল ক্ষমতার অন্ধমােহ এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। ক্ষমতার প্রতি অন্ধমােহ মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে জ্ঞানহীন করে ফেলে।

 বহুজাতিক দেশ ছিল এই ভারতবর্ষ। বিভিন্ন ধর্মমত এ দেশে বিদ্যমান ছিল। ধর্মে ধর্মে বৈরিতা ও বিদ্বেষ রাজক্ষমতায় যেকোনো সময় বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এই আশঙ্কায় আকবর শংকিত ছিলেন। আর এই আশংকা দূরীকরণের উপায় ছিল ধর্মসমূহের পারস্পরিক ব্যবধান উঠিয়ে সর্ববাদী একটি ধর্মের প্রবর্তন করা। উল্লেখ্য এ দেশে ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট বিবাদমান পরিস্থিতিকে সুশান্ত করণের আবেদন নিয়ে বহু নেতা ও নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল ইতিপূর্বেই। ভাববাদী মতাদর্শ নামের একটি দল বহু পূর্বে থেকেই এ দেশে ধর্মের ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে সব ধর্মের ভাবাদর্শের সমন্বয় ঘটিয়ে একটি সর্বজনীন ধর্মাদর্শ গড়ে তুলে সব মানুষকে একই সূত্রে গেঁথে ফেলার কাল্পনিক স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল। আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের বাবা শেখ মুবারক ছিল ভাববাদী দর্শনের একজন বলিষ্ঠ প্রচারক। আবুল ফলও সেই চিন্তা চেতনা নিয়েই গড়ে উঠেছিল। ভাববাদী মতাদর্শের চেতনার পক্ষে আকবরকে কাজে লাগানাের মানসে তারা অক্ষরজ্ঞানহীন সম্রাটকে একটি সর্বাদী ধর্মের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং নিজেকে সকল ধর্মানুসারীদের পৌরহিত্যের আসনে অধিষ্ঠিত করে ক্ষমতার মসনদকে নিষ্কণ্টক করে তােলার জন্য এটি একটি মুক্ষম পন্থা বলে তারা তাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 সম্ভবত এই উভয়বিধ ক্ষমতা লিপ্সায় অক্ষরজ্ঞানহীন আকবরকে একটি নতুন ধর্ম সৃষ্টি করতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। সকল ধর্মের সারবস্তু কি তা অনুধাবন করার জন্যই আকবর তাঁর দরবারে বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদেরকে আহ্বান জানাতেন এবং তাদের থেকে প্রত্যেক ধর্মের সারবস্তু অনুধাবন করার চেষ্টা করতেন। ধর্মগুরুরা আকবরের এহেন উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে না পেরে এটাকে পরধর্মের প্রতি আকবরের উদারনীতি মনে করে প্রত্যেকেই নিজ ধর্মের সারবত্তা বর্ণনা করেন মুক্ত মনে। আর এভাবেই আকবর তার নিজের জ্ঞানানুসারে যে ধর্মের যে বিষয়কে ধর্মের সারবস্তু মনে করেছেন সেগুলােকে সমন্বয় করে দ্বীনে-ইলাহীর নকশা তৈরি করেন। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ও এ ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক কারণ হিসাবে কাজ করেছে। যেমন:

১। ভক্তি ও মাহদী আন্দোলনের প্রভাব:

 এ আন্দোলনের প্রচারকার্য লক্ষ্য করে ক্ষমতার পাগল আকবরের মনে এক নতুন অভিলাষ সৃষ্টি হয় যে, তিনিও একজন ধর্ম প্রবর্তক হবেন। 

২। হিন্দুদের প্রভাব:

 হিন্দু রাজপুতদের সাথে অবাধ উঠাবসার কারণে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। আকবর নিজে ধর্মগুরু হয়ে বিভিন্ন ধর্ম থেকে কিছু কিছু নিয়মনীতি আহরণ করতঃ সেগুলােকে মিশ্রিত করে এমন একটি ধর্মমত দাঁড় করিয়েছিলেন যাতে সব ধর্মেরই কিছু কিছু প্রথা বিদ্যমান থাকে। এতে একেশ্বরবাদী ইসলামকে বহুশ্বরবাদী ধর্মসমূহের সাথে মিশ্রিত করে এমন একটা রূপ দান করা হয়েছিল। যাতে ইসলামের আকীদাহ-বিশ্বাস ও বিধি-বিধান মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল। দ্বীনে-ইলাহীর রীতিনীতি ও দ্বীনে-ইলাহীর কতগুলাে নির্ধারিত রীতিনীতি ছিল। যথাঃ
  •  এ ধর্মের কলেমা ছিল “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলীফাতুল্লাহ।”
  • জন্মবার্ষিকী পালন এবং বিভিন্ন উৎসবে স্বধর্মীদের ভােজের আমন্ত্রণ করতে হত। | 
  • তার অনুসারীরা পরস্পর সাক্ষাৎকালে নতুন প্রথায় সম্ভাষণ করত। প্রথম
  • ব্যক্তি বলত, “আল্লাহু আকবার” দ্বিতীয় ব্যক্তি “জাল্লা-জালালুহু” বলে প্রতি
  • উত্তর দিত।
  • মদ, জুয়া, ও সুদ এ ধর্মে বৈধ ছিল। |
  • সম্রাট আকবরকে সিজদা করা ও দাঁড়ি মুণ্ডনকে বৈধ মনে করা হত।
  • পর্দা প্রথাকে রহিত করা হয়েছিল এবং কেউ মুসলমান হতে পারবে না। এ মর্মে নির্দেশ জারী করা হয়েছিল।
  • কসাই, জেলে প্রভৃতি নিমজাতের লােকদের সাথে মেলামেশা পরিহার করার নির্দেশ ছিল।
  • অগ্নিকে পবিত্র মনে করা হত এবং সব ধর্মকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার বিধান ছিল।
  • ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ যাকাতের বিধান রহিত করা হয়েছিল। 
  • শূকর এবং কুকুর নাপাক হওয়ার হুকুম রহিত করা হয়েছিল।
  • ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্জব্রত পালন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
  • হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। 
এক কথায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রথা অনুসরণ করা হত। এগুলাে ছাড়াও দ্বীনে ইলাহীর অনুসারীদের জন্য আরাে অনেক আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি পালন করতে হত। যারা এ ধর্মের অনুসারী ছিল তাদেরকে চারটি জিনিস যথা- ধন, জীবন, সম্মান ও ধর্ম সম্রাটের জন্য উৎসর্গ করতে হত। উপরােক্ত আলােচনার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, বাদশাহ আকবরের প্রচারিত “দ্বীনে ইলাহী” -এর কারণে উপমহাদেশ থেকে সত্যিকার দ্বীন ইসলাম চিরতরে বিদায় নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক তাঁর চিরন্তন নিয়মের আওতায় বাতিলের বিরুদ্ধে হকের পাতাকা সমুন্নত রাখার জন্য কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে থাকেন। যেখানে ফেরাউন ছিল, সেখানে হাতে লাঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন মুসা আ, কে, আবু জেহেল, উতবা ও শায়বার বিরুদ্ধে হিদায়াতের জাদুকরী বাণী দিয়ে পাঠালেন সরওয়ারে দু আলম সা. কে। ঠিক তেমনি আকবরের ভ্রান্ত আকীদা ও ধর্মমতকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়ার জন্য পাঠালেন হযরত শায়েখ আহমাদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহ. কে।

মুজাদ্দিদে আলফে সানীর আন্দোলন:

পবিত্র ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করা ও আকবরের ভ্রান্ত ধর্মনীতি দ্বীন-ই-ইলাহীকে সমূলে উৎখাত করার জন্য শায়েখ আহমাদ সেরহিন্দ রহ, সমস্ত ভয়-ভীতি ও সমূহ বিপদকে গ্রাহ্য না করে স্বীয় অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য ইস্পাত কঠিন ঈমানী শক্তি ও মনােবল নিয়ে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি এই মরণপণ সংগ্রামে কামিয়াব হন। তাঁরই নিরবচ্ছিন্ন সগ্রামের ফলশ্রুতিতে তদানীন্তন মুসলমানদের জীবনে ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণেই তাকে মুজাদ্দিদে আলফে সানী বলা হয়।

দ্বীনে ইলাহীর অসারতা:  

নিছক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার উদ্দেশ্যে হিন্দুদের অন্তর জয় করার জন্য সম্রাট আকবর সকল সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি শরীয়ত বিরােধী ও সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানি নিয়ম-প্রথা চালু করেন। এই সকল কর্মকাণ্ডকে যদিও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়, তবুও এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, উপমহাদেশে আকবরের এহেন কর্মকাণ্ডের পরিণতি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর। জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। রাজদরবারের এহেন পদক্ষেপের ফলে সমগ্র দেশব্যাপী অস্থিরতা বিরাজ করা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। ফলে মুহাম্মদ যায়দী ফাতওয়া দেন যে, সম্রাট পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেন, তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ওয়াজিব। এদিকে হিন্দু রাজা বীরবলসহ সর্বমােট আঠার জন। আকবরের ধর্মমত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সম্রাটের প্রিয়পুত্র ও সেনাপতি মানসিংহ প্রকাশ্য দরবারে এ ধর্ম অসারতা প্রমাণ করেছিলেন। 

মৃত্যুঃ ১৬০৫ খ্রীষ্টাব্দে ইতিহাসের বিতর্কিত সম্রাট আকবর ইন্তেকাল করেন।