ঘুর বংশ ও দাস বংশের ভারত শাসন - ইসলামী ইতিহাস
ঘুর বংশের ভারত শাসন:
গজনীর সম্রাটদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে ঘুর বংশের সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী গজনী বংশের শেষ সুলতান খসরু মালিককে পরাজিত করে ১১৭৩ খ্রীঃ গজনীর ক্ষমতা দখল করেন। এতে করে গজনী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। মুহাম্মদ ঘুরী গজনী অধিকার করেই ভারত অভিযানে আত্মনিয়ােগ করেন। সে সময়ে দিল্লী ও আজমীরে চৌহান বংশ, সিন্ধুতে সুমরা গােত্র, কনৌজে গহঢ়বাল বা রাঠোর বংশ, গুজরাটে চালুক্য বংশ, বিহার ও বাংলায় পাল ও সেন বংশ রাজত্ব করত। মুহাম্মদ ঘুরী একে একে এসব এলাকাই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অধিকার করে নেন। তবে বলতে গেলে ভারত অভিযানের ক্ষেত্রে তাঁর ক্রীতদাস ও সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবেকের সাহসিকতাই অনেকটা মুখ্য ভূমিকা রেখে ছিল। তবে এ বিজয়ের সুফল তিনি বেশি দিন ভােগ করতে পারেননি। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে খােখার বংশীয় জনৈক ব্যক্তির হাতে তিনি অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তারই ভ্রাতুষ্পুত্র গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ সিংহাসনে আরােহণ করেন। পরবর্তীতে মাহমুদের উত্তরাধীকারীগণ ক্ষমতা নিয়ে গােলযােগ সৃষ্টি করলে খাওয়ারিজমের শাহ ঘুর রাজ্যে আক্রমণ করে তা অধিকার করে নেন এবং ঘুর বংশের শাসনের পতন ঘটে।
ঘুর বংশ ও দাস বংশের ভারত শাসন - ইসলামী ইতিহাস |
দাস বংশের ভারত শাসন:
মুহাম্মদ ঘুরী যে বছর মৃত্যুবরণ করেন সে বছরই তার সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবেক দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করেন। ঐতিহাসিকদের ধারণায় তিনিই হলেন দিল্লির প্রথম সুলতান। কুতুবুদ্দীন আইবেক প্রতিষ্ঠিত রাজ বংশ ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লিতে রাজত্ব করেন। কুতুবুউদ্দীন আইবেক যেহেতু সুলতান। মুহাম্মদ ঘুরীর ক্রীতদাস রূপে জীবন শুরু করে ছিলেন তাই তার প্রতিষ্ঠিত রাজ বংশকে কোন কোন ঐতিহাসিক দাস বংশ' নামেও আখ্যা দিয়েছেন। কুতুবুদ্দীন চার বছর দিল্লির শাসনকার্য পরিচালনা করে ১২১০সালে নভেম্বর মাসে চৌগান বা পলাে খেলতে গিয়ে এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন। কুতুবুদ্দীনের মৃত্যুর পর আরাম শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। কিন্তু অল্প কালের মাঝেই তিনি জনগণের নিকট অপ্রিয় হয়ে উঠেন। এ সুযােগে কুতুব উদ্দীন আইবেকের জামাতা ও বাদায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিশ ১২১১ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর নিকটে এক যুদ্ধে আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন।
সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন দিল্লীর মসনদে তুর্কী বংশের দীর্ঘস্থায়ী সম্রাট। তিনি প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত দিল্লীর সিংহাসনের অধিপতি ছিলেন। তিনি তার এ দীর্ঘ শাসন কালে অনেক এলাকা অধিকার করেন। তিনি ন্যায় পরায়ণতা ও উদারতার মাধ্যমে জনমনে সৎ শাসক হিসাবে স্থান করে নিয়ে ছিলেন। ১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এ মহান শাসক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার কন্যা সুলতানা রাজিয়াকে পরবর্তী সম্রাট ঘোষণা করে ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু সম্রাটের এ মনােনয়ন আমীর উমারাদের নিকট মনপুতঃ না হওয়ায় তারা সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাদায়ূনের শাসনকর্তা রুকুন উদ্দীন ফিরােজকে বলপূর্বক দিল্লীর মসনদে বসান। কিন্তু সুলতানের অদক্ষতার সুযােগে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এবং রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাজিয়া এটাকে সুবর্ণ সুযােগ মনে করে নিজের পক্ষে জনমত তৈরি করে এবং রুকুন উদ্দীন ফিরােজের অনুপস্থিতিতে দিল্লীর মসনদ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ফিরােজ দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করলে তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়। পিতার মৃত্যুর সাত আট মাস পর অর্থাৎ ১২৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজিয়া ক্ষমতা পুনঃ দখল করে।
সে ক্ষমতা লাভ করে রাজ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রতি মনােনিবেশ করে। নারী হয়েও সে তার বুদ্ধিমত্তা ও দুরদর্শিতার মাধ্যমে ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করে। অতঃপর ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতানা রাজিয়া ও তার স্বামী ইখতিয়ার উদ্দিন আলতুনিয়া এক হিন্দু আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়। রাজিয়ার। মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা বাহরাম শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি মাত্র। দু’বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। নিজের অযােগ্যতার দরুন সংঘবদ্ধ আমীর দল কর্তৃক যারা ‘বান্দেগান-ই-চেহেলগান বা চল্লিশ অভিজাত নামে পরিচিত ছিল- দিল্লির 'শ্বেত দুর্গে' অবরুদ্ধ হয়ে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর ১২৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিশের পৌত্র মাসুদ সিংহাসনে আরােহণ করেন। মাসুদ দুঃশাসন ও ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে সম্রাট হিসাবে অযােগ্য বলে বিবেচিত হন। ফলে রাজ্যের অভিজাতগণ ১২৪৬ খ্রীষ্টাব্দে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার পিতৃব্য সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদকে সিংহাসনে বসান। সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ ছিলেন দরবেশ বা খােদাভীরু ও ন্যায় পরায়ণ শাসক। তিনি প্রায় কুড়ি বছর শাসন কার্য পরিচালনা করে ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার। প্রধানমন্ত্রী ও শ্বশুর গিয়াসুদ্দীন বলবনকে তার উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান। ৬০ বছর বয়সে গিয়াসুদ্দীন বলবন সিংহাসনে আরােহণ করেন। সিংহাসনে আরােহণ করে তিনি শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমন ও বহির্শক্তির আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তুর্কী সালতানাতে সুলতান ইলতুৎমিশের পর তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত সফল রাষ্ট্রনায়ক। তার শাসনামলে শরীয়তের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দুনীতি ও পাপাচার নিবারণ এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার এক নজির বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। এ মহান রাষ্ট্রনায়ক অত্যন্ত সফলতার সাথে দীর্ঘ ২২ বছর রাজত্ব করেন। সুলতান বলবনের দুই পুত্র ছিল। শাহজাদা মুহাম্মদ ও বুগরা খান। মুহাম্মদ তার জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করায় দ্বিতীয় পুত্র বুগরা খানকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে ১২৮৭ খ্রীঃ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বুগরা খান তখন ছিলেন বঙ্গদেশের শাসনকর্তা। সালতানাতের এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি তার কর্মস্থল বঙ্গদেশে ফিরে আসেন। কাজেই বলবনের মৃত্যুর পর অভিজাতগণ বুগরা খানের ১৮ বছরের সন্তান কায়কোবাদকে সিংহাসনে বসান।
কিন্তু এই অল্প বয়স্ক সুলতান ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সাম্রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দরবারীদের মাঝে তুর্কি অভিজাত সম্প্রদায় ও খিলজী আমীরগণ দু'দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং খিলজীগণ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠে। এদিকে বিভিন্ন অনিয়ম ও অনাচারের ফলে কায়কোবাদ পঙ্গু হয়ে পড়েন। এহেন পরিস্থিতিতে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য তুর্কিগণ ১২৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কায়কোবাদের তিন বছর বয়স্ক সন্তান কাইমুর্সকে সিংহাসনে বসান। এতে করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই ঘােলাটে হয়ে যায়। এই বিশৃংখলার সুযােগে খিলজী সম্প্রদায়ের নেতা ফিরােজ খিলজী রাজধানী দিল্লীতে প্রবেশ করে অল্প বয়স্ক | সুলতানকে অবরােধ করে ১২৯০ খ্ৰীষ্টাব্দে জালাল উদ্দীন ফিরােজ শাহ উপাধি গ্রহণ করে দিল্লীর সুলতান হিসাবে সিংহাসনে আরােহণ করেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন