ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ এর জীবনী - Tips Tune

 হযরত শাহ আব্দুল আযীয রাহ.-এর ‘দারুল হরব” ঘােষণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলে যারা আন্দোলন মুখর হয়ে উঠেছিলেন, হাজী শরীয়তুল্লাহ রাহ, ছিলেন তাদের অন্যতম। নীলকর সাহেবদের দ্বারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত দেশবাসীর কাছে তিনি ছিলেন মুক্তির স্বপ্ন পুরুষ। হিন্দু জমিদারদের দ্বারা উৎপীড়িত মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন ত্রাণকর্তা স্বরূপ।

 ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান শরীয়তপুর জিলার মাদারীপুরের অন্তর্গত শামাইল নামক গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। আট বৎসর বয়সে পিতা আব্দুল জলীল তালুকদার মারা গেলে তিনি চাচা আযীম উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। ১৮ বৎসর বয়সে হজ্জ করতে গিয়ে দীর্ঘ ২০ বৎসর কাল আরব জাহানে অবস্থান করতঃ শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে স্বদেশের মানুষের হিদায়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে পূর্ণ ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন, নির্যাতিত মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রতকরণ, পরাধীনতার অক্টোপাস ছিন্ন করে | স্বাধীনতার মন্ত্রে মুসলমানদেরকে উজ্জীবিত করণই ছিল তার মিশনের মূল উদ্দেশ্য।

ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা  হাজী শরীয়তুল্লাহ  এর জীবনী। হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন ধর্মীয় সংস্কারক। জন্ম সাল: ১৭৮৬ সালে Tips Tune
হাজী শরীয়তুল্লাহ (রহ:)

এ সময় বঙ্গদেশীয় অঞ্চলে হিন্দু সভ্যতার প্রভাবে কবর পূজা, পীরকে সিজদা করাসহ বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এ সকল বিদ’আত ও কুসংস্কার উচ্ছেদ করতঃ বিশুদ্ধ ইসলামী চিন্তাধারা পুনঃ প্রতিষ্ঠার মানসে তিনি। গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে মানুষকে বুঝাতে থাকেন। ইসলামের যে সকল ফরজ বিধান মানুষ ছেড়ে দিয়েছিল সেগুলাে বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি অধিক গুরুত্বারােপ করতেন। এজন্য তার আন্দোলন ফরায়েজী আন্দোলন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাছাড়া ইংরেজদের হাতে নিগৃহীত মানুষের মুক্তি এবং ইংরেজদের তল্পিবাহক | হিন্দু জমিদারদের দ্বারা উৎপীড়িত মানুষের মুক্তির চিন্তাও তাকে দারুণভাবে বিচলিত করে। ইংরেজদের চক্রান্তের শিকার এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক 'দুরবস্থার বিষয়টি তাকে দারুণভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজদের অধীনতা স্বীকার করে নিয়ে এ দেশের মুসলমানদের জন্য সত্যিকারের ইসলামী জীবনাদর্শের অনুসরণ সম্ভব হবে না।

 এ কারণে শাহ আব্দুল আযীয রাহ. ও সাইয়্যিদ আহমদ রাহ, এর আন্দোলনের ধারা অনুসরণ করে তিনি বঙ্গ দেশকে ‘দারুল হরব' বা শত্রু কবলিত দেশ বলে ঘোষণা দেন। যেহেতু দারুল হরবে জুমা ও ঈদের নামায আদায়ের বিধান নেই; এ কারণে তিনি এ দেশে ঈদ ও জুমার নামায বিধি সম্মত নয় বলে ফতওয়া প্রদান করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন বঙ্গের মুসলিম জাগরণের অগ্রপথিক। তার আদর্শ ও চিন্তা চেতনার প্রভাবে সারা দেশে একটি ধর্মীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। তাঁর অবিচলতা ও অবিরাম কর্মতৎপরতার ফলে সারা দেশে ধীরে ধীরে আত্ম-সচেতনতা জাগরিত হয় এবং দলে দলে লােক তার আন্দোলনে এসে শরিক হতে থাকে। সারা দেশের মানুষকে এই নতুন চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করার মানসে তিনি ঢাকা, বরিশাল, পাবনা ও ময়মনসিংহসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করেন এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। তার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক গণজাগরণ ইংরেজ নীলকর সাহেবদের জন্য ও তাদের পােষ্য জমিদার শ্রেণির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং মুসলমানদেরকে নানাভাবে হয়রানি করতে শুরু করে।

 যােগেশচন্দ্র বলেন: ‘জমিদার ও নীলকরের অত্যাচারে মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ ও দুর্বিষহ হয়ে উঠে।’ জেমস ওয়াইজ লিখেছেন যে, ‘জমিদাররা প্রজাদের উপর নানারকম অবৈধ কর বসাতে শুরু করে। এমনকি দুর্গাপূজা, কালীপূজা ইত্যাদি হিন্দু উৎসবের জন্যও মুসলমানদের কর দিতে হত।’ এহেন পরিস্থিতিতে হাজী শরীয়তুল্লাহ জমিদার ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করেন। পূর্ববঙ্গের কৃষকেরা দলে দলে তার আন্দোলনে যােগ দিতে থাকে।’ 

ক্রমে হাজী শরীয়তুল্লাহ হিন্দু জমিদার ও নীলকর কুঠিয়ালদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ান। ১৮৩১ সালে ঢাকার নয়াবাড়ি নামক স্থানে প্রচারাভিযান চালানোকালে হিন্দু জমিদারদের সাথে তার ভীষণ সংঘাত বেধে যায়। কতিপয় মুসলমান হিন্দু জমিদারদের পক্ষ অবলম্বন করে তার প্রচারকার্যে বাধা দান করলে তিনি দারুণভাবে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে স্বগ্রামে ফিরে যান। তার অব্যাহত কর্মতৎপরতার ফলে সারা দেশে মুসলমানদের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল ফরায়েজীদের সাংগঠনিক তৎপরতার আওতায় চলে আসে। 

১৮৪০ সালে এই সমাজসংস্কারক, মর্দেমুজাহিদ ইহধাম ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মুহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া এ আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন। ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্রগতি ও সাংগঠনিক কর্ম তৎপরতায় তিনি তাঁর পিতাকেও ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন।