ভারতবর্ষে মুসলমান ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের আগমন - পর্ব: ১
ভারতবর্ষে বহিঃশক্তির অনুপ্রবেশ প্রাচীনকাল থেকেই অব্যাহত ছিল। এ দেশের ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের কথা রূপকথার ন্যায় বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিল। ধন-রত্নে পূর্ণ এ উপমহাদেশের প্রতি বহিঃবিশ্বের দৃষ্টি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হত। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকেরা এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আগমন করত। পুরো আলোচনা ৩টি পর্বে ভাগ করেছি। প্রথম পর্বে আরব বণিকদের আগমন,তুর্কীদের বণিকদের আগমন, পর্তুগীজদের বণিকদের আগমন, ওলন্দাজের বণিকদের আগমন ও ফরাসী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। পুরো ইতিহাসটি একেবারে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছি।
আরবদের আগমন ও ইসলামের প্রভাব:
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদীনায় রাসূলে কারীম সা. কর্তৃক ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাত্র এক শতাব্দীর মাঝে মুসলমানগণ পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, স্পেন, মধ্য এশিয়া, এমনকি ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত দখল করে ইসলামের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। মুসলমানদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক সােনালী অধ্যায়ের সূচনা হয়। ৭১০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম এর সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে এখানে যে সত্য ও সুন্দরের বিজয়। পতাকা উত্তীর্ণ হয়েছিল তা স্থির লক্ষ্যে পৌছে ১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে তরাইনের যুদ্ধে শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরীর বিজয় এবং চৌহান রাজ ও পৃখিরাজের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে। মুসলিম শাসনের বুনিয়াদ স্থাপন করে মুসিলম সুলতান ও বাদশাহগণ ন্যায় ও ইনসাফের শাসন দ্বারা এ দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইসলামী তাহজীব- তামাদুনের সংমিশ্রণে ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছিল এক স্বর্গীয় আবাসভূমিতে। দিগ্বিজয়ী আরবদের প্রতি অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। রামপ্রাণ গুপ্ত বলেন ‘ইসলাম ধর্মের অভ্যুদ্বয়ের অব্যবহতি পরেই মুসলমানগণ স্বর্ণপ্রসূ ভারতবর্ষের প্রতি সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করে ছিলেন। এ সময় হতে আরবগণ পরম্বাপহরণ মানষে বহুবার ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণরূপে অমূলক। অপর একজন প্রখ্যাত হিন্দু ঐতিহাসিক বলিষ্ঠ ভাষায় এর প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, ভারতবর্ষে বলপূর্বক ইসলাম বিস্তার করা, হয় নাই; কারণ ইতিহাসে অমুসলমানদের প্রতি অকথ্য নির্যাতনের কোন নজীর। নাই। স্যার থমাস আরনল্ডের মতে অত্যাচারী ও নিপীড়কদের বর্বরতা অথবা গোড়া পন্থীদের নির্যাতনে ইসলাম ধর্ম প্রচারের মূল সূত্র পাওয়া যাবে না বরং সওদাগর ও ধর্ম প্রচারকদের আত্মত্যাগ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ইসলাম পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। ভারতবর্ষে সর্ব প্রথম মালাবারে মুসলমান আরব ব্যবসায়ীগণ আগমন করেন। পরবর্তীতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতবর্ষে মুসলমান ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের আগমন |
তুর্কীদের আগমন:
রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের দিক থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয় তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। আব্বাসীয় খলীফাদের শাসনামলে অর্থাৎ সিন্ধু অভিযানের প্রায় আড়াই শতাব্দী পর যে সব মুসলমান ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রয়াস পান তারা আরব ছিলেন না, তারা ছিলেন নব-দীক্ষিত তুর্কী মুসলমান। দুর্বল আব্বাসীয় খলিফাদের দরবারে তেজোদীপ্ত তুর্কীদের প্রাধান্য উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। ৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কী বংশ -যা গজনী বংশ নামে পরিচিত ছিল- গজনীতে স্বীয় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। পরে এরাই ভারত বর্ষের মুসলিম শাসনের স্থায়ী বুনিয়াদ গড়ে তােলেন এবং ৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকেন।
পর্তুগীজদের আগমন:
ভৌগােলিক আবিষ্কারের দিক থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন দুঃসাহসিক পর্তুগীজগণ। প্রিন্স হেনরী নাবিকদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সমুদ্র অভিযানের প্রশিক্ষণ দান করেছিলেন। ফলে তারা আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল সম্পর্কে জানতে পারে। ১৪৭১ খ্রিষ্টাব্দে তারা বিষুবরেখা অতিক্রম করে এবং ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দে কঙ্গো পর্যন্ত অভিযান করে। ১৪৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত পর্তুগীজ নাবিক বার্থালােমিউডিয়াজ দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করেন। ১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজা ইয়ামুয়েলের পৃষ্ঠপােষকতায় ভাস্কো-দা-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ পার হন এবং আরব নাবিকদের সহযােগিতায় ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে মে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। ভাস্কো-দা গামার ভারতবর্ষে আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগের সূচনা করে। কালিকটের স্থানীয় রাজা জামেরীন তাকে আতিথ্য দান করেন। তবে আরব বণিকদের সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি হওয়ায় ভাস্কো দা-গামা তিন মাস অবস্থানের পর ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হন। ভাস্কো-দা-গামার জলপথ আবিষ্কারের পর এ দেশে পর্তুগীজ বণিকগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে আসতে শুরু করে। তারা সর্ব প্রথম ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে গােয়াতে তাদের কুঠি স্থাপন করে এবং ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে তা বাংলায় স্থানান্তরিত করে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম, সাতগাঁও, হুগলী প্রভৃতিস্থানে পর্তুগীজরা তাদের বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। পর্তুগীজদের কৃতিত্বপূর্ণ আমদানী রপ্তানীর ফলে হুগলী জনবহুল সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে রেশমী কাপড়, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, বাদাম ইত্যাদি বাংলাদেশে আমদানী করত। বাংলা থেকে চাল, ডাল, ঘি, তেল ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করত। কালক্রমে পুর্তগীজরা ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতিনীতি উপেক্ষা করে দেশীয় জনগণের উপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে এবং সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সরকারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এসব নানাবিধ কারণে সম্রাট শাহজাহান পুর্তগীজদের বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কাশিম খান ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে তার সেনাবাহিনী নিয়ে হুগলী দুর্গ অবরােধ করেন এবং তাদেরকে হুগলী থেকে বিতাড়িত করেন এবং বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান তাদেরকে চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ থেকে চিরতরে বিদায় করে দেন।
ওলন্দাজ:
হল্যান্ডের একদল উৎসাহী বণিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে মার্চ মাসে ডাচ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী গঠন করে ভারতবর্ষে আগমন করে। তারা ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে মসলিপট্রমে, এবং ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে পুলিকটে কুঠি স্থাপন করে। বাংলায় ওলন্দাজদের প্রধান কুঠি ছিল উঁচুড়া (১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে) বালেশ্বর, কাশিম বাজার, বরা নগর প্রভৃতি স্থানে। ওলন্দাজরা এদেশ থেকে কাঁচা মাল রেশমী সুতা, সুতি বস্ত্র, চাল, ডাল প্রভৃতি বিদেশে রপ্তানী করত। সুমাত্রা, যা প্রভৃতি দ্বীপ থেকে বিভিন্ন প্রকার মশলা আমদানী করত। কালক্রমে তাদের বাণিজ্য বর্তমান মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সীমিত হয়ে পড়ে। দিনেমার ? ডেনমার্কের অধিবাসীরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ১৬১৬ খ্রীষ্টাব্দে দিনেমার ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী গঠন করে ভারতে আগমন করে এবং তারাও বিভিন্ন স্থানে কুঠি স্থাপন করে। তাদের কুঠিগুলাের মাঝে ১৬৬৭ সালে ত্রিবাঙ্কুর ও শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠিত কুঠিদ্বয় ছিল প্রসিদ্ধ। কিন্তু বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তেমন সুবিধা করতে না পেরে ১৭৪৫ সালে ইংরেজদের কাছে তাদের কুঠিগুলাে বিক্রি করে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
ফরাসী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী:
ফরাসী সম্রাট চতুর্থ লুই-এর রাজত্বকালে তারই অর্থসচিব কোলবার্ট “ফরাসী ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী” গঠন করেন। সম্রাট এই কোম্পানীকে পর্যাপ্ত অর্থ ঋণ দান করেন। ১৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রাঁসােয়া ক্যারাে সর্ব প্রথম সুরাটে ফরাসী বাণিজ্য-কুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বৎসর মারকারা মৌসলিপট্রমে অপর একটি কুঠি স্থাপন করেন। ১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজের সন্নিকটে ওলন্দাজদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়, এবং ফরাসীগণ পরাজিত হয়। ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রাঁসােয়া মার্টিন ও লেসপিনে পন্ডিচেরিতে একটি ফরাসী উপনিবেশ স্থাপন করেন। ১৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খান ফরাসীদের বাংলায় চন্দন নগরে একটি বাণিজ্য-কুঠি নির্মাণের অনুমতি দেন। ১৬৯০-৯২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝে চন্দন নগর একটি শক্তিশালী ফরাসী সুরক্ষিত কুঠিতে পরিণত হয়। ১৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে সেটি ওলন্দাজগণ কর্তৃক অধিকৃত হলে পুনরায় তা ফরাসীদের ফেরত দেয়া হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ফরাসী ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর অর্থবল হ্রাস পেলে মৌসুলিট্রম, সুরাট ও সানটোমের কুঠি তারা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৭০২ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী কোম্পানী পুনরায় গঠিত হলে তারা মাহে ও কারিকল বন্দর পুনরুদ্ধার করে। বাংলায় ফরাসীরা বলেশ্বর, কাশিমবাজার, চন্দন নগর প্রভৃতি স্থানে কুঠি স্থাপন করে। ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের পরে ইংরেজদের সাথে প্রতিযােগিতামূলক বাণিজ্যে টিকে থাকার প্রশ্নে তারা ক্রমশঃ রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মনোনিবেশ করেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন