ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন ও রাজ্য বিস্তার - ইসলামী ইতিহাস
সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীনদের যুগে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন ও ধর্ম প্রচার:
ভারতবর্ষের মাটিতে মানুষের আদিবাস কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও সুমেটিক আর্যরা ইরান থেকে এসে এ-এলাকায় বসতি গড়ে তােললে ক্রমান্বয়ে আর্য সভ্যতাই যে এ দেশের অধিবাসীদের সভ্যতায় রূপান্তরিত হয় -এ কথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। আর্য হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল তখন অত্র অঞ্চলে। কিন্তু যে আদর্শবাদীতার উপর হিন্দু ধর্মের গােড়াপত্তন হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে অবলুপ্ত হলে এবং শ্রেণী বৈষম্যের নির্মম জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে বৌদ্ধের সাম্যের বাণী জনগণকে আকৃষ্ট করেছিল। ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধরাই এ দেশের রাজ্য ক্ষমতা দখল করে নেয়। ফলে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মাঝে দীর্ঘ সাম্প্রদায়িক বিরােধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু কৃচ্ছতার যে মহৎ শিক্ষা এক কালে হিন্দুদেরকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল, কালে তার আদর্শানুসারীরা স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম তার আবেদন হারিয়ে ফেলে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ সময় নেতিয়ে পড়া হিন্দু ধর্মের সংস্কার করে ব্ৰহ্মণ্যবাদের গোড়াপত্তন করে। এক সময় তারা বৌদ্ধদের থেকে হৃত ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু ব্রহ্মণ্যবাদের আদর্শবাদীতা বিলুপ্ত হয়ে যখন ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হল সাধারণ মানুষ, ধর্মকে পুঁজি করে যখন ব্রাহ্মণরা মানুষের উপর জুলুম ও নির্যাতনে বেপরােয়া হয়ে উঠল এবং তাদের কাজে প্রতিবাদ করলে অভিশাপ দিয়ে স্ববংশে নির্মূল করার ভয় দেখিয়ে মানুষের সর্বস্ব লুটে নিয়ে সর্বশান্ত করতে শুরু করল, তখন কৃচ্ছতাসাধনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করে সুখময় সমাজ গড়ে তােলার শ্রুতিমধুর স্লোগান নিয়ে আসল যােগীবাদ।
আত্মপীড়ন ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ ছিল যার মূল দীক্ষা। নারী স্পর্শ মহাপাপ বলে নারীদের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখল এ আদর্শের অনুসারীরা নিজেদেরকে। কিন্তু প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলে এই কৃচ্ছতা বেশি দিন টিকল না। ফিৎরাতের তাড়নায় কৃচ্ছতা ভঙ্গ করতে বাধ্য হল তারা। এভাবে যুগীবাদও হারালাে তার আপাত মােহনীয় স্লোগানের আবেদন। অপরদিকে হিন্দু, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ ও যােগীবাদের অনুসারীরা পরস্পর বিরােধিতার ফলে গােটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল শ্ৰেণীবৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক আত্মকলহ। ফলে ভারতবর্ষ বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। উপমহাদেশের মানুষের আদর্শিক জীবনে তখন নেমে এসেছিল এক চরম হতাশা ও অস্থিরতা। ঠিক এহেন বৈষম্য ও বর্ণভেদ পীড়িত সামাজিক পটভূমিতে সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের পয়গাম নিয়ে তাওহিদী আদর্শের কেতন উড়িয়ে ইসলাম এসেছিল এই ভূখন্ডে।
ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন ও রাজ্য বিস্তার - ইসলামী ইতিহাস |
টি, এইচ, অর্নান্ডের মতে: ইসলাম এ দেশে এসেছিল যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত মূক, মূঢ় জনগণের মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আয়তনে প্রায় ইউরােপ মহাদেশের সমান, নানাদিক থেকে আকর্ষণীয়, বিচিত্র এই ভারত উপমহাদেশ। স্মরণাতীত কাল থেকে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সিন্দু ও গঙ্গা বিধৌত অববাহিকা, পলি গঠিত উর্বর ভূমি, অসংখ্য পর্বত, ভূ-প্রকৃতির বিচিত্র গঠন, অসংখ্য মূল্যবান খনিজ ও ধাতব পদার্থ, নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য ও বহু ধরনের কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন ক্ষেত্র হিসাবে এ দেশের প্রতি বিদেশিদের দৃষ্টি সহজেই আকৃষ্ট হত! সুপ্রাচীন কাল থেকেই আরবদের সাথে এ দেশের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন ধরনের মশল্লা, উৎকৃষ্ট মানের বস্ত্র, সুগন্ধি ও কাঁচামালের জন্য তারা এ দেশে আনাগোনা করতে অহরহ। সম্ভবত বাণিজ্যের এপথ ধরেই সর্বপ্রথম মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও সুফি সাধকেরা এ দেশের মাটিতে পদার্পণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক সূত্রে যতটুকু প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে হযরত উমর রা. কর্তৃক পারস্য বিজয়ের পর উপমহাদেশীয় অঞ্চলের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি প্রসারিত হয় এবং তখন থেকেই মুসলমানরা ভারত অভিযানের চিন্তা ভাবনা শুরু করে। অবশ্য শাসক রূপে মুসলমানদের ভারতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগ থেকেই সুফী সাধক ও ধর্মপ্রচারকদের বদৌলতে এ উপমহাদেশের মানুষের সাথে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম ইসলামের পরিচয় ঘটে।
ইসলাম প্রচারক, মানব কল্যাণে উৎস্বর্গীত প্রাণ, খােদাভীরু, আউলিয়া ও দরবেশগণের সুমহান চরিত্র মাধুরী ও মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডে বিমুগ্ধ হয়ে এ দেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষ করে হিন্দুবর্ণবাদী শ্রেণি এবং বৈষম্যের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষেরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং ইসলামের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুপম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সন্ধান পেয়ে যথা নিয়মে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ না করলেও তাদের মানসিক সমর্থন ঝুঁকে পড়েছিল ইসলামের দিকেই। এ কারণেই দেখা যায় যে, ধর্ম প্রচারকগণ শাসনক্ষমতার অধিকারী না হয়েও একেক এলাকায় নিজেদের আদর্শিক প্রভাব বিস্তার করতঃ ক্রমান্বয়ে তারা মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশেষ করে উপমহাদেশের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় তাদের আগমন ঘটে সর্বাগ্রে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ঢাকার উপকূলীয় অঞ্চল, রংপুর এবং ভারতের দক্ষিণাত্যের এলাকাসমূহে, মুলতান, আহমদাবাদ, পাঞ্চাব ও সিন্ধুতে এবং সিন্ধুর নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে যথা দেবল, মানসুরাহু খােজ্জদার একালায় তাদের বসতি গড়ে উঠেছিল ব্যাপকহারে। এ সকল এলাকায় ধর্মপ্রচার, মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণ এবং ইসলামী শিক্ষাদীক্ষা বিস্তারে তারা ব্যাপক হারে মনােনিবেশ করেন। তাদের খােদাভীরুতা, সৎ ও মার্জিত জীবনবােধ এবং ন্যায়পরায়ণতায় বিমুগ্ধ হয়ে তাদের হাতে ব্যাপক হারে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।
নব দীক্ষিত মুসলমানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তারা স্থায়ীভাবে এসব এলাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। হযরত উমর রা. কর্তৃক নিযুক্ত বাহরাইন ও ওমানের শাসনকর্তা প্রখ্যাত সাহাবি হযরত উসমান বিন আবুল আস-আস-সাকাফী রা, স্বীয় ভ্রাতা আল-হাকামকে সিন্ধুর বরুচ অঞ্চলে এবং অপর ভ্রাতা মুগীরাহ বিন আবুল আসকে দেবল অভিযানে প্রেরণ করলে তারা তথাস্তু ক্ষমতাসীনদেরকে পরাস্ত করে ভারতের সীমানায় প্রথম ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করেছিলেন। এ সময়ে আগত সাহাবিদের মাঝে যাদের নাম জানা যায় তারা হলেন- আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ ওতবান, আশইয়াম বিন্ আমর তামিমী, সােহার বিন আল্ আবদী সুহাইল বিন আদী প্রমূখ। হযরত উসমান রা. এর শাসনামলে তৎকর্তৃক নিযুক্ত মাকরানের শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ বিন্ মা'মার তামিমী সিন্ধু নদ পর্যন্ত ভূ-ভাগ স্বীয় শাসনাধীন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া সৈন্য বাহিনীর অনুকূল হচ্ছে না জানতে পেরে খলিফা সৈন্যদেরকে সম্মুখে অগ্রসর হতে নিষেধ করেন। এ সময় আগত সাহাবীদের মাঝে হযরত আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ (রা.) এর নাম ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ৩১ হিজরি সনে সিজিস্তানের শাসক রূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সিন্ধু অঞ্চলের বহু এলাকা নিজের অধিকারে আনতে সক্ষম হন। হযরত আলী রা, এর খিলাফত কালে উনচল্লিশ হিজরির প্রথম দিকে তাঁর অনুমতি ক্রমে হারিস বিন মুররাহ আবদী নামে একজন বীর মুজাহিদ একদল স্বেচ্ছাসেবী সৈন্য নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন এবং সিন্ধুর উত্তর পশ্চিম অঞ্চল উসমানী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু ৪২ হিজরিতে তিনি সিন্ধু'র কিকান নামক স্থানে। প্রতিপক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সদলবলে নিহত হন। হযরত মুআবিয়া রা, এর যুগে প্রথমে আব্দুল্লাহ বিন সাওয়ার আবদী অতঃপর সিনান বিন সালামাহ হুযাইলী ভারত সীমান্তে আক্রমণ করেন। পরে ৪৪ হিজরীতে প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মদ বিন্ আবু সুফরাহ ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবের লাহাের ও বান্না এলাকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে ছিলেন। হযরত মুআবিয়া রা, এর পরবর্তীকালে মুসলমানদের ঘরােয়া সমস্যার কারণে ভারতবর্ষের প্রতি খুব একটা মনােযােগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু উমাইয়া বংশের আল-ওয়ালীদ সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামের ইতিহাসে আবার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ওয়ালীদের শাসনামলে তার প্রখ্যাত সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর সমগ্র উত্তর আফ্রিকা অধিকার করে নেয়। অন্যতম সেনাপতি তারিক স্পেন জয় করে সেখানে ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন